সংসারই চলে না, চিকিৎসার খরচ কোথায় পাবে সাইমের পরিবার?

প্রতিবেদন : মোহাম্মদ আবু বক্কর

চট্টগ্রাম, ১০ হাটহাজারী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে অনার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল টগবগে তরুণ মো. সাইম। বয়স সবেমাত্র ১৯।

ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা শেষ করে পরিবারের হাল ধরবে। অভাবের সংসারে বাবা-মায়ের দুঃখ ঘুচাবে। কিন্তু সব আশাই এখন গুড়ে বালি। সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দিন কাটছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মো. সাইমের। ক্রাচে ভর দিয়ে কোনভাবে দাঁড়াতে পারলেও এখনো সে হাঁটতে পারেনা। আদৌ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারবে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তাঁর পরিবার।

হাটহাজারী উপজেলার ৮নং মেখল ইউনিয়নস্থ রুহুল্লাপুর গ্রামের বুধা গাজী বাড়ির মোহাম্মদ সিরাজ (৪৮) ও রাশেদা বেগম (৪৩) দম্পতির একমাত্র পুত্র মো. সাইম। দুই বোন ও এক ভাই এর পরিবারে সে মেজো। ধার দেনা করে এবং এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বড় বোন সাইমা আক্তারের (২৩) বিয়ে হয়েছে বছরখানেক আগে। ছোট বোন মরিয়ম আক্তার সাইফা (১২) স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। সাইমের বাবা মোহাম্মদ সিরাজ ‘নিরাপত্তা প্রহরীর’ চাকুরি করেন। স্বল্প আয়ের চাকুরি করে অভাব অনটনের মধ্যে দিনাতিপাত করলেও ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কখনো কার্পণ্য করেননি তিনি।

 

 

ঘটনার বিবরণে সাইম জানায়, সাইম ও তাঁর বন্ধুরা শুরু থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিল।গত ৫ই আগষ্ট দুপুর ১২টায় সে তাঁর বন্ধুদের সাথে হাটহাজারী কলেজ মাঠে একত্রিত হয়। হাটহাজারী কলেজ মাঠ থেকে মিছিল নিয়ে তাঁরা হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ডের দিকে যায়। দুপুর ২টার দিকে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শত শত ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে মিছিল বের করে। এসময় মিছিলকারী ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অতর্কিত গুলি চালাতে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি তাঁর ডান পায়ের উরুতে এসে লাগে। বুলেটটি তাঁর পকেটে থাকা মোবাইল ভেদ করে উরুর এক টুকরো হাড়সহ বেরিয়ে আসে। গুরুতর আহত অবস্থায় বন্ধুরা তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ১২দিন পর চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার করে উরুতে রড লাগানো হয়।

দীর্ঘ একমাস চিকিৎসা শেষে বাড়িতে আসলে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় সে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে সার্জিস্কোপ, সিএমএইচ সহ আরও কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি। এখন ডাক্তাররা বলছেন দ্রুত তাঁর পায়ে পুনরায় অস্ত্রোপচার করাতে হবে। শরীরের অন্যস্থান থেকে হাড় নিয়ে তাঁর ডান উরুতে লাগাতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিভাবে অস্ত্রোপচারের খরচ যোগাবে তা নিয়ে বিপাকে পড়েছে তাঁর পরিবার।

 

 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে আমরা বন্ধুরা মিলে প্রতিটা কর্মসূিচতে অংশগ্রহণ করি। বিশেষ করে জুলাই মাসের ১৫তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের নৃশংস হামলার ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। সেদিন থেকে শপথ করি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের যৌক্তিক দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে থাকব। সবচাইতে বড় বিষয় হচ্ছে, এই আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। যা আমাকে আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ছাত্র সমাজের দাবি মেনে নিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার পালাতে বাধ্য হয়েছে এটাই আমাদের আন্দোলনের সার্থকতা। দেশটা আমাদের সকলের,আমরা সবাই দেশকে ভালোবাসি। আমরা চাই একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা। এদেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে কেউ যেন কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার না হয়। পুরোপুরি সুস্থ হবো কিনা জানিনা, তবে দেশের জন্য কিছু করতে পেরে আমি গর্বিত।

ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন সাইমের মা রাশেদা বেগম। তিনি বলেন, পরিবারের একমাত্র আশার প্রদীপ সুস্থ ছেলেটি তিনমাস ধরে বিছানায় পড়ে আছে।

হাসপাতালে সরকারি খরচে অপারেশন হলেও ওষুধ ও চিকিৎসা বাবদ ইতোমধ্যে প্রায় দুই লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেছে। চিকিৎসার খরচ মেটাতে স্থানীয় একটি এনজিও থেকে একলক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছি। আমার স্বামী যা রোজগার করেন তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ডাক্তাররা বলেছেন দ্রুত আরেকটি অপারেশন করাতে না পারলে তাঁর পা ঠিক হবেনা। ছেলের চিকিৎসা বাবদ এত টাকা খরচ হলেও সমন্বয়কদের দেওয়া ৩০হাজার টাকা ছাড়া সরকারি-বেসরকারিভাবে আর কোন সহযোগিতা পাইনি। এখন আমরা ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করবো? নাকি ছেলের চিকিৎসার খরচ চালাবো?

কথা হয় সাইমের বাবা মোহাম্মদ সিরাজ এর সাথে। নিদারুণ কষ্ট,অশান্তি আর হতাশার ছাপ তাঁর চেহারায় ফুটে উঠেছে। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বলেন, আমার একটি মাত্র ছেলে।

অনেক কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছি। আশা ছিল ছেলে বড় হবে, চাকুরি করে আমাদের দেখাশুনা করবে। এখন সে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবে কিনা তাও জানিনা। ছেলেটার চিকিৎসা করাবো সে টাকাও নেই। আমি যা রোজগার করি তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। মাস শেষে ধার দেনা করে চলি। তাঁর চিকিৎসার জন্য ইতোমধ্যে ঋণ নিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন আবার অপারেশন লাগবে। এই পরিস্থিতে তাঁর চিকিৎসার খরচ চালানো আমার জন্য দুর্বিষহ একটি ব্যাপার। তাই সরকারের পক্ষ থেকে যদি তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে সে হাঁটতে পারবে। পাশাপাশি ছেলেকে একটি সরকারি চাকুরি দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি যাতে আমার অভাবগ্রস্ত পরিবারের সহায়তা হয়।

সাইমের ছোট বোন সাইফা বলেন, ভাইয়া প্রতিদিন সকালে আমাকে মাদ্রাসায় দিয়ে আসতো এবং ছুটির পর নিয়ে আসতো। এখন সংসারের কাজ ফেলে আমার মাকে যেতে হয়, অন্যথায় আমার মাদ্রাসায় যাওয়া হয়না। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি আমাকেও পড়াতো। এখন সারাদিন তাঁকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়।

সাইমের জ্যেঠা আবুল কালাম বলেন, ছোটবেলা থেকে সে খুব শান্ত শিষ্ট। কখনো কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ করেনি। এলাকায় যে কারো আপদে-বিপদে সবার আগে ছুটে যেত।

দেশের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তার পায়ে গুলি লেগেছে। পায়ের অবস্থাও খুব খারাপ। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরিবারটি আর্থিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত। সরকার যেন তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসে এবং তাকে যেন একটি সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয়, এটাই আমাদের দাবি।

 

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবি এম মশিউজ্জামান বাসস প্রতিনিধিকে বলেন, ‘সাইম এর বিষয়ে আমি অবগত। আন্দোলনে আহত হওয়ার কারণে সে ডিগ্রীতে ভর্তি হতে পারেনি। ভর্তির বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। সরকারিভাবে কোন সহযোগিতা পেলে অবশ্যই তাদের পৌঁছে দেয়া হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও পরিবারটির পাশে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial